আজকাল নিছক মনস্তাত্ত্বিক লেখা খুব একটা পড়া হয়না। থ্রিলারই বেশি পড়ি। সম্প্রতি পড়লাম মাইকেল কনেলির ‘ব্লাড ওয়ার্ক’ বইটি। পড়তে গিয়ে প্রথম প্রথম মনে হলো, এই যাহ! কয়েক পৃষ্ঠায় ত বুঝেই গেলাম আসল রহস্য কী। একটা সময় একটু অধৈর্য যে হয়ে পড়িনি তা বলব না। কিন্তু কিছু দূর এগুতেই যেন জেঁকে বসলো বইটা। অবশ্য যেহেতু আমি অনুবাদ পড়েছি, তাই অনুবাদকের কৃতিত্বও কিন্তু অনেক। ইশরাক অর্ণব খুব চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন এই বইয়ে।
আপনি যদি একটি মনস্তাত্ত্বিক সত্তার সাথে অপরাধ জগতের কল্পকাহিনী উপভোগ করতে চান তবে ‘ব্লাড ওয়ার্ক’ অবশ্যই পড়া উচিত।
টেরি ম্যাকেলেব একজন সাবেক এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট যার সম্প্রতি হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে। তিনি সুস্থ হওয়ার সময় তার হার্টের দাতার বোনের (গ্রেসিয়েলা রিভারস) কাছ থেকে একটি ছবি পান। গ্রাসিয়েলা নিজেই নিয়ে আসেন। তিনি ম্যাকেলেবকে একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধের মাধ্যমে খুঁজে বের করেন এবং তাকে তার বোনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেন।
টেরি প্রথমে গ্রেসিয়েলাকে ফিরিয়ে দেন কারন ডক্টরের কথা অনুযায়ী অস্ত্রোপচারের পরে এত তাড়াতাড়ি এই ধরণের কাজের চাপ নেয়ার জন্য তাঁর শরীর একেবারেই প্রস্তুত নয়। কিন্তু গ্লোরিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা, নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা ও শরীরের নাজুক অবস্থার মধ্যে দ্রুতই দ্বন্দ্ব অনুভব করা শুরু করেন তিনি। তীব্রভাবে ম্যাকেলেব এটাও অনুভব করেন যে তিনি গ্রেসিয়েলা এবং তার বোন গ্লোরিয়া তোরেস উভয়ের কাছেই ঋণী।
টেরি নিজের সংযোগগুলো কাজে লাগাতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আসলে তার এজেন্ট সত্তার আগ্রহের কাছে উনার দুর্বল শরীরের প্রতি ডাক্তার বনি ফক্সের নিষেধাজ্ঞা ম্লান হয়ে যায়। খুনের দু মাস পর গ্রেসিয়েলা খোঁজ পেয়েছেন তার বোনের হার্ট যার বুকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তিনি প্রাক্তন এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট আর তখনই তার মনে ক্ষীণ আশা জেগে উঠেছে বোনের খুনিকে ধরার। খুব আশা নিয়ে আসা গ্রেসিয়েলা কে শেষমেশ হতাশ হতে হয়না। ম্যাকেলেব তার বন্ধু গোয়েন্দা জে উইনস্টনের সাথে যোগাযোগ করেন যাকে উনি আগে থেকেই চিনতেন এবং একসাথে কাজও করেছেন। কিন্তু ব্যাজবিহীন সাবেক একজন এফবিআই স্পেশাল এজেন্টের পক্ষে একটা কেস চালিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের। যার ফলে প্রথমেই এই গ্রেসিয়েলা খুনের কেসের তদন্তকারী পুলিশ অফিসার আরোঙ্গো ও ওয়াল্টারের সাথে তৈরী হয়ে যায় দ্বন্দ্ব, আর ম্যাকেলেবকে সাহায্য নিতে হয় যে উইনস্টনের।
একদম সিসি ক্যামেরার ভিডিও থেকে ম্যাকেলেবের যাত্রা শুরু হয়। কয়েক মিনিটের রেকর্ডেড ভিডিও থেকে পুলিশ যেই খুনকে কেবল একটি ডাকাতির মামলা হিসেবে ধরে নিয়েছিল সেখানে ম্যাকেলেব খুঁজে পান, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খুনের গন্ধ। এভাবেই শুরু হয় পাঠকের কাছে এক নতুন অধ্যায়। একটি সাধারণ দোকান ডাকাতি রূপ নেয় ভিন্ন আদলে। ম্যাকেলেব যত বেশি মামলাটি সম্পর্কে জানতে পারে, ততই সে খুনিকে খুঁজে বের করতে অস্থির হয়ে পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত, সত্যের সঙ্গে জীবনযাপন করা তার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কঠিন হয়ে যায়।
বইটি চমত্কার, গতি দুর্দান্ত এবং আপনাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে। এর সাসপেন্স ফ্যাক্টর চমৎকার এবং সাথে ম্যাকেলেব ও গ্রেসিয়েলার মধ্যে গড়ে ওঠা রোম্যান্স একটি অন্য স্বাদ যোগ করেছে। এটি কনেলির সৃষ্ট চরিত্রের দুর্দান্ত অংশ যে, তারা শুধু এক-দ্রষ্টব্য চরিত্র নয় বরং তাদের প্রত্যেককে সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হবে, ভালো, খারাপ বা এর মাঝামাঝি। আপনার যদি রহস্য ভালো লাগে এবং এখনও ‘ব্লাড ওয়ার্ক’ না পড়ে থাকেন তবে আমি বলব এই উপন্যাস আপনার তৃষ্ণা চমৎকারভাবে মেটাবে। এর গতি আপনাকে পৃষ্ঠাগুলিতে আটকে রাখবে।
বইটির জনপ্রিয়তার কারনে ২০০২ সালে একই নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়। সিনেমাটিতে টেরি ম্যাকেলেবের চরিত্রে অভিনয় করেন আমার খুব পছন্দের একজন অভিনেতা ক্লিন্ট ইস্টউড। কেন জানি আমার মনে হয়, ইস্টউডই ম্যাকেলেব চরিত্রের জন্য সব থেকে উপযুক্ত কাস্ট ছিলেন। যদিও বই আর সিনেমার গল্প বলার ধরন, সময়কাল আর পরিণতি তে বেশ পার্থক্য আছে, তবে আমার ধারণা, ক্লিন্ট ইস্টউড কে চরিত্রের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য এই পরিবর্তন গুলো করা হয়েছে। আইএমডিবি তে সিনেমাটার রেটিং ৬.৪।