পৃথু ঘোষ চেয়েছিল, বড় বাঘের মতো বাঁচবে। বড় বাঘের যেমন হতে হয় না কারও উপর নির্ভরশীল—না নারী, না সংসার, না গৃহ, না সমাজ— সেভাবেই বাঁচবে সে, স্বরাট, স্বয়ম্ভর হয়ে। তার বন্ধু ছিল তথাকথিত সভ্য সমাজের অপাঙক্তেয়রা। পৃথু ঘোষ বিশ্বাস করত, এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মের দিন সমাসন্ন। সে-ধর্মে সমান মান-মর্যাদা এবং সুখ-স্বাধীনতা পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ। বিশ্বাস করত, এই ছোট্ট জীবনে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে প্রতিটি মানুষকে। শুধু প্রশ্বাস নেওয়া আর নিঃশ্বাস ফেলা বাঁচার সমার্থক নয়।……………….
আসলে পৃথু কি পেরেছিল তার স্বপ্নের সমান বড় হয়ে বাঁচতে নাকি সমাজ (তথাকথিত!) তাকে আঁকড়ে ফেলেছিল তার নিজের বেড়াজালে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসে উপন্যাস ‘মাধুকরী’।
বুদ্ধদেব গুহ ঔপন্যাসিক হিসেবে খুব সূক্ষ্ম বিচক্ষণশালী একজন ব্যক্তি। তাঁর লেখায় বর্ণনা কেবল নিছকই বর্ণনা নয়, এর সাথে মিশে থাকে বিশ্লেষণ প্রকৃতির ও আত্মার। মানুষের গহীন কোণে কে বা কী নাড়া দিয়ে যাচ্ছে দ্বিধা দ্বন্দ্বের দোলাচালে তাইই যেন কালি কলমে বাস্তব হয়ে ওঠে বুদ্ধদেবের লেখায়।
বুদ্ধদেব গুহ রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গাঢ় মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি তাঁর পাঠকদের এমন এক অসাধারণ মহাসমুদ্রে নিয়ে যান, যেখানে প্রকৃতি, মানবজীবন এবং মানসিক ও সামাজিক সম্পর্কের নানান দিক খুবই সুন্দরভাবে বর্ণিত। মহাসমুদ্রের বিভিন্ন স্তরের যেমন গাঢ় থেকে গাঢ়তর অঞ্চল আছে তেমনি ‘মাধুকরী’ উপন্যাসের রয়েছে অনেক গাঢ় থেকে গাঢ়তর অঞ্চল। পাঠকের মনে হবে সবটাই ত জানা হলো, কিন্তু মহাসমুদ্রের মতোই রয়ে যায় অনেক অনাবিষ্কৃত অঞ্চল।
মাধুকরী স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। এর পুংলিঙ্গ মধুকর বা মধু সংগ্রহ করে যে। এর আরেকটি অর্থ আছে, যে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। আমাদের সমাজের কিছু মানব-মানবী নানা জনের দ্বারে দ্বারে প্রেম ভিক্ষা বা মধুকরের মত বৃত্তির চেষ্টা চালায় যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি অনুগত বা বিশ্বস্ত না থেকে বহু স্থান হতে অল্প অল্প পরিমাণে ভালবাসা সংগ্রহ করে বা করতে চেষ্টা করে। এখানে মাধুকরী বলতে লেখক দেখাতে চেয়েছেন, উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তথা অনেকেই প্রেম-ভালবাসার জন্য কিভাবে স্বামী/ স্ত্রী একে অন্যকে ছেড়ে নানা জন এবং নানা জায়গায় মধুকরের মত ঘুরে ঘুরে প্রেম-ভালবাসার চেষ্টা চালায় এবং পরিশেষে সমাজের দৃষ্টিতে এই অসামাজিক কাজের শেষ ফল আসলে কী হয় তাই নিয়েই এই উপন্যাস ‘মাধুকরী’।
মাধুকরী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পৃথু ঘোষ, যাকে সবাই আড়ালে ‘পাগলা ঘোষসা’ বলে। কারণ সে কখন কী করে না করে, কার সাথে চলে কার সাথে চলে না এসব কিছুরই ঠিক নেই। বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ার, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ভাল রোজগারও করে। এতে করে সে হতে পারত সমাজের এলিট শ্রেণির প্রতিনিধি। কিন্তু সে সমাজের এলিট শ্রেণির তথাকথিত জীবনযাপন পছন্দ করেনা। সে ভালোবাসতো কবিতা লিখতে, গান শুনতে আর বনে জঙ্গলে ঘুরতে। আর মিশত সমাজের উঁচু-নিচু সবার সাথে তথা ভুচু (মোটর মেকানিক), শামিম (ঘড়ি সারাই মিস্ত্রী), কুর্চি (নিমু কাকার মেয়ে/পৃথুর প্রাক্তন প্রেমিকা), সাবির মিয়া (মুসলমান বন্ধু), দিগা পাড়ে (সংসার বিবাগী), ঠুঠা বাইগা (কাজের লোক), গিরিশদা (অবিবাহিত ও অবসরপ্রাপ্ত একজন) এবং বিজলি (বাঈজী)। সমাজের তথাকথিত পার্টিতে অংশগ্রহণ বা ক্যারিয়ার-সংসার নিয়ে চিন্তা কোনটাই করা তার পছন্দ নয়।
পৃথু ঘোষ প্রথম জীবনে ভালবাসত তার নিমু কাকার মেয়ে কুর্চিকে। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর তার কাকা তার বিয়ে দিয়ে দেন রুষার সাথে। বিয়ের দীর্ঘদিন পরও এবং পুত্রকন্যাপূর্ণ পরিবার থাকা সত্ত্বেও সে ছুটত কুর্চি তথা প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে একটু ভালবাসা পাওয়ার আশায় এবং বউয়ের কাছে প্রত্যাখাত হয়ে ছুটে গিয়েছে বাঈজী বিজলীর কাছে। কারণ বউয়ের সাথে সদ্ভাব না থাকা, মানসিক দূরত্ব, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব আর তারই ফলাফল এইসব বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক।
পৃথুর স্বপ্ন ছিল এক নির্ভেজাল স্বাধীন জীবন যেখানে সমরুচির ভালবাসা থাকবে, থাকবে যার যা প্রাপ্য সেই সম্মান। কিন্তু এমন ইউটোপিয়া ত আর বাস্তব না। তাইত তার কাঙ্ক্ষিত সুখ তার জীবনে রয়ে গেছে অধরা। ভাগ্যের পরিহাসে পৃথু অঙ্গ (ডান পা) হারানোর পর বুঝতে পারে ভালবাসা এবং নিজের সুখের পিছনে ছুটতে ছুটতে সে কতো দূর চলে গেছে তার পরিবার, ছেলেমেয়ে, সমাজ থেকে। যেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব না তার পক্ষে।
অপরদিকে পৃথু ঘোষের সুশীল সুন্দরী স্ত্রী রুষা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, সমাজকর্মী, বাইরের সবার সাথে মিশুক মহিলা (society girl ) এবং সুখের পিছে ছোটা এক নারী যাকে ঘর থেকে বাহিরই বেশি টানে। যার কাছে স্বামীর প্রেম তথা স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার থেকে বাহিরের পুরুষদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য বেশি। বিবাহিত জীবনে স্বামীর সাথে মানসিক দ্বন্দ্বের জেরে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে তোলে সফল ব্যবসায়ী ও তীব্র রোমান্টিকতায় ভরপুর ভিনোদ ইদুরকারের সাথে। আর নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত এক নারীতে পরিণত হয় স্বামীর তীব্র উদাসীনতা আর মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে। সুখের পিছে ছুটে ঘরের সুখকে পা দিয়ে পিষে ফেলেছে। ভাগ্যের পরিহাসে পৃথু ঘোষ অঙ্গ হারানোর পরে সে পৃথুকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে ছেলে মেয়ে নিয়ে ভিনোদ ইদুরকার এর ঘরে। কিন্তু কর্মফল খুব তিক্ত জিনিস। দিন কয়েক না ঘুরতেই ইদুরকারের আসল চেহারা বের হয়ে যায়।
এছাড়াও অন্যান্য চরিত্র কুর্চি, বিজলী, ভুচু, শামীম, সাবির, দিগা পাড়ে, ঠুঠা বাইগা, গিরিসদা ,ডাকু মগনলাল ,উধাম সিং তাদের নিয়েও অনেক ছোট-বড় ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে উপন্যাসে।
উপন্যাসটির মূল থিম হল মানব প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক। লেখক প্রকৃতির সাথে মানুষের অভিন্নতা এবং সম্পর্কের জটিলতা খুবই সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। পৃথুর জীবনের নানা পর্যায়ে আসা বিভিন্ন নারীর সাথে তার সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের মাধ্যমে তার মানসিকতার পরিবর্তন উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
‘মাধুকরী’ উপন্যাসটি বুদ্ধদেব গুহর অনবদ্য সাহিত্যিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে। তার গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি, প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এই উপন্যাসকে একটি অনন্য সৃষ্টি করে তুলেছে। উপন্যাসটি পাঠকদের প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানব জীবনের জটিলতা নিয়ে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
বুদ্ধদেব গুহর ‘মাধুকরী’ একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং গভীর উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এটি শুধু একটি উপন্যাস নয়, বরং প্রকৃতি এবং মানব জীবনের এক মেলবন্ধনের কাহিনী, যা পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম। লেখকরা সমাজের দর্পণ। তারা সমাজের অতীত অবস্থার সাথে বর্তমানের তুলনা করে ভবিষ্যতের একটি ছবি তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। লেখক তার বইটি একুশ শতকের নর-নারী কে উৎসর্গ করেছেন কিন্তু কেন? লেখক দেখিয়েছেন যে, বর্তমানে মানুষ তার ব্যক্তি স্বাধীনতার, ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতা এবং নারী স্বাধীনতার নামে যে লাগামহীন জীবন যাপন করছে তার ভবিষ্যত পরিণতি কী হবে বা হতে যাচ্ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নারী স্বাধীনতার নামে নর-নারী নির্বিশেষে সবাই যে জীবন যাপন করছে তার ফলে সামাজিক শৃংখলা নষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে অশান্তি, মানসিক দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে স্বামী/স্ত্রী জড়িয়ে পড়ছে বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে। আর তার প্রভাব পড়ছে ছেলে-মেয়েদের ও ওপর। তাইত পৃথু-রুষার মেয়ে মিলি অশালীন আচরণের শিকার হয় মায়ের প্রেমিক ইদুরকারের হাতে।
উপন্যাসটি পড়ার শুরু করার পর থেকেই ভাল লাগবে কারণ প্রত্যেকটা চরিত্র খুব আকর্ষণীয়, জীবন্তভাবে ফুটে উঠবে। তার সাথে জঙ্গলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা, নানান রকম পাখি, গাছ, পশুপাখির বর্ণনা, দল নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে শিকার করা, ডাকাত দলের সাথে লড়াই সব কিছুই যেনো চোখের সামনে ভাসবে লেখকের লেখার সাবলিলতায়। চরিত্রগুলো যেনো সবার চোখের সামনেই কথা বলছে, খাচ্ছে, হাঁটছে, হাসছে, অভিমান করছে এমন অনুভব হবে কারণ লেখক কতটুকু পরিশ্রম করে লিখেছেন তা বইটি পড়ার সময় বুঝা যায়। আর একটা বিষয় হচ্ছে এই উপন্যাসে অনেক লেখক-কবিদের নিয়ে এবং বাংলা সাহিত্য নিয়ে লেখক অনেক আলোচনা করেছেন। বইটি পড়ে প্রায় মাঝামাঝি আসার পর থেকে খারাপ লাগবে কারণ উত্থানের পর এমন নির্মম পতন মেনে নেয়া যায় না তেমনি পৃথু ঘোষের অংগহানী এবং রুষার স্বামী সংসার ত্যাগ এগুলি মেনে নেয়া ও কষ্টদায়ক । পড়তে পড়তে চরিত্রের অনুভূতি গুলো অনুভব করতে করতে হারিয়ে যেতে হয় লেখকের লেখার মাঝে। পাঠকের জন্য এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা হবে।
লেখক এই উপন্যাসে বোঝাতে চেয়েছেন- মানুষ মাত্রই প্রকৃতির অংশ, মানুষ সামাজিক জীব তাই একা বেঁচে থাকা কখনোই সম্ভব না, জীব জন্তু পাখি তাদেরও অনুভূতি আছে, মানুষ হয়ে আমরা শুধু প্রকৃতির ক্ষতিই করছি, নিজের সুখকে বড় করে দেখলে বা নিজের সুখ খোঁজার জন্য দ্রুত বেগে ছুটে চললে জীবনে সব কিছু হারাতে হয়। বর্তমানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মাঝেই অধিক সুখ, বৈচিত্র তথা বৈবাহিক বর্হিভূত সম্পর্ক তথা পরকীয়া মহামারীর আকার ধারন করেছে। আর বৈবাহিক বর্হিভূত সম্পর্ক তথা পরকীয়ার শেষ পরিণতি কী হয় তা লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখনির মাধ্যমে।
সব কিছুর শেষে লেখক এটাই প্রমাণ করেছেন যে, সংসার জীবনে যাই হোক না কেন, পরিবার-সংসার-সন্তানের মধ্যেই স্বামী- স্ত্রীর আসল সুখ লুকানো থাকে একে অন্যকে শুধু একটু সময় দিয়ে, মন দিয়ে, আবেগ-ভালবাসা দিয়ে সেই সুখকে খুঁজে নিতে হয়। আর এর জন্য স্বামী স্ত্রীর মাঝে সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখা উচিত এবং কখনো তাদের সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় কারো প্রবেশাধিকার দেয়া উচিত নয়। কারণ সেই তৃতীয় জনই সুখের ঘরের বেড়া নিজেদের অগোচরেই কেটে ফেলে ইদুরের মত। আর যখন তারা তা বুঝতে পারে তখন আর সেই ধ্বংসের পথ থেকে বেরিয়ে আসা যায়না। “মাধুকরী” এই শতকের মানুষের জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী প্রজন্মের মানুষের সার্থকভাবে বেঁচে থাকার ঠিকানা। এই কারনেই বুঝি এই উপন্যাস উৎসর্গ করা হয়েছে “একবিংশ শতকের নারী-পুরুষদের” হাতে। সাধারণ পাঠকের মন ও বুদ্ধিমান পাঠকের মনন- দুজনেরই একসংগে ঝংকার তোলার উপন্যাস মাধুকরী। এর কাহিনী, ভাষা, স্টাইল, জীবনদর্শন, শ্লীলতা-অশ্লীলতার সীমারেখা -সবই নতুন। জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মাঝে লুকিয়ে থাকা বিতৃষ্ণাকে যে চমকপ্রদ ভংগিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যে নৈপুণ্যে বর্ণনায় এনেছেন সূক্ষ্মতা, যে কুশলতায় ছোট-বড় প্রতিটি চরিত্রকে দেখিয়েছেন চিরে-চিরে, যে দক্ষতায় দেশি-বিদেশি অজস্র কবিতার ব্যবহার করেছেন সে সবই পাঠককে এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতার স্বাদ দিবে । আর তাই একথা নিঃসন্দেহ বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন ‘মাধুকরী’।