“দ্য হুইস্পার ম্যান” বইটি লিখেছেন অ্যালেক্স নর্থ এবং এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সালমান হক। বইটির কাহিনী শুরু হয় টম কেনেডির স্ত্রী হঠাৎ মারা যাওয়ার পর। টম সিদ্ধান্ত নেন তার ছেলে জেককে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করবে। তারা ফিদারব্যাঙ্ক নামক একটি শহরে চলে আসে। যে শহরটির রয়েছে একটি ভয়াবহ অতীত। আর সেই অতীতের সাথে টমের রয়েছে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক, আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি যে, এই ব্যাপারে টমের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা। বিশ বছর আগে ফ্রাঙ্ক কার্টার নামের একজন সিরিয়াল কিলার এই শহরে পাঁচটি শিশুকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল। তাকে “দ্য হুইস্পার ম্যান” বলা হতো কারণ, সে রাতের বেলায় তার শিকার শিশুদের জানালায় এসে ফিসফিস করে কথা বলত। এমনকি জেকের পছন্দে ফেদারব্যাঙ্কের যেই বাড়িটি টম কিনলেন সেটিরও রয়েছে নিজস্ব রহস্য।
নতুন শহরে আসার পর টম জানতে পারে আবার একটি ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায় আর শহরের মানুষজন ফ্র্যাংক কার্টারের কথা মনে করতে শুরু করে। নতুন করে জেগে ওঠে হুইস্পার ম্যানের স্মৃতি। কারণ, অনেকের ধারণা ছিল, সকল অপকর্মে হুইস্পার ম্যানের একজন সহকারীও ছিল।
ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর আমান্ডা বেকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শহরের পুলিশ ফোর্স দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে নিখোঁজ বাচ্চাটাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের প্রচেষ্টা করতে থাকে। এই পর্যায়ে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, সিনিয়ার ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর পিট উইলিস এর সাথে। যার জীবনের সেরা সাফল্য গুলোর একটা হল, সিরিয়াল কিলার ফ্র্যাংক কার্টারকে চিহ্নিত ও বন্দি করা। এই রহস্য সমাধান করতে পারায়, স্বভাবতই পাঠকের প্রত্যাশা থাকে একজন ডাকসাইটে নায়কের আবির্ভাবের। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনেই লেখক আমাদেরকে এই জায়গাটিতে হতাশ করেছেন। ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টার আমান্ডা বেক ব্যক্তিগত অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্টেশন চিফের সরাসরি হস্তক্ষেপে পিটের সাথে মিলে একসাথে এই কেসে কাজ শুরু করতে বাধ্য হন। কারণ, সমস্ত আলামত থেকে এমন একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল যে, এই শিশুটির নিখোঁজ হওয়ার সাথে, ফ্র্যাংক কার্টারের কোন না কোন সংযোগ আছে। আর পিটের থেকে ভালোভাবে ফ্র্যাংক কার্টারকে আর কেউ জানেনা।
আর এই সব কিছুর সাথে কিভাবে টম এবং জেক জড়িয়ে গেল, ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কীভাবে জেলে বসে এই হত্যাকাণ্ডে কলকাঠি নাড়লো, টম-জেকের রহস্যময় বাড়ির রহস্য উদঘাটন হল কিনা, এই সবকিছু জানার জন্য “দ্যা হুইস্পারম্যান” বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
দ্য হুইস্পারম্যান বইটি একটি সিরিয়াল কিলিং আবহ নিয়ে লেখা হলেও আসলে বইটি যতটা না সিরিয়াল কিলিং থ্রিলার, তার থেকে অনেক বেশি ছোট পরিসরে লেখা ফ্যামিলি মিস্ট্রি থ্রিলার। এখানে তিন জোড়া বাবা-পুত্রের সম্পর্কের জটিলতা ঘিরে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। একজন সিরিয়াল কিলার কে বিশ্লেষণ করে আর একজন সিরিয়াল কিলার কে, তা খুঁজে বের করার মধ্যে দিয়ে সবগুলো পিতা-পুত্র সম্পর্ককে এক সুতায় গাঁথার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে বইটা।
উপন্যাস টিতে গতি রয়েছে, রয়েছে রোমান্স। সাথে রয়েছে সম্পর্কগত জটিলতা এবং রহস্য। বইটা কোনভাবেই ভালো পাঠককে একঘেঁয়েমিতে আক্রান্ত করবেনা
তবে সমাপ্তি নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই একটু হতাশা রয়েছে। আমার মনে হয়, আলেক্স নর্থ খুব তাড়াহুড়া করে উপন্যাসটির সমাপ্তি টেনে ফেলেছেন। উপন্যাসে টম কেনেডি এবং তার ছেলে জেকের মধ্যে ঝামেলার মূল কারণ হলো তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা এবং টমের স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাদের জীবনে আসা পরিবর্তন। টম তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং জেকও তার মায়ের অনুপস্থিতিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে।
পিট উইলিস এবং তার সন্তানের সম্পর্কটিও বেশ জটিল এবং গভীর। পিট উইলিস বর্তমানে একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ গোয়েন্দা হলেও, একসময় তিনি কিন্তু ছিলেন একজন মদ্যপ ও আত্নবিশ্বাসহীন মানুষ। সেরকম একজন মানুষ থেকে এরকম চৌকশ পুলিস অফিসার হয়ে ওঠার পথে পিটকে, সন্তানকে হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি জীবনে যত সংগ্রাম করা লেগেছে, সেগুলোও পাঠকের মনে গভীর ভাবে আচড় কাটতে বাধ্য। সম্পর্কের জটিলতা গল্পটির প্রাণ হওয়ার কারণে, আমার মতে এই গল্পটি আর একটু ভালো আর প্রাঞ্জল সমাপ্তি ডিজার্ভ করত। তবে শুধু পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতা না, উপন্যাসটিতে সাইকোপ্যা্থিক উপাদানও যথেষ্ট পরিমানে বিদ্যমান। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে লেখা গল্পে যা অবিচ্ছেদ্য উপাদান। তবে আমাকে স্বীকার করাই লাগবে যে, সাইকোপ্যাথিক উপাদানগুলোকে বইটিতে যেই দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটা আমার কাছে একেবারেই পরিচিত ছিল না। যা আমার ধারনা পাঠকের কাছে একটা বড় চমক হয়ে আসবে। এই বইটিতে সুযোগ থাকার পরেও নারী চরিত্রগুলোকে আরেকটু ভালোভাবে ডেভেলপ করা গেলে মনে হয় লেখাটা আরো শক্তিশালী হত। আমার কাছে নারী চরিত্রগুলোর বিকাশের ব্যাপারটাকে অনেকটাই অবহেলিত মনে হয়েছে।
উপন্যাস টিতে বেশ কিছু অসাধারণ ডায়ালগ রয়েছে যা লেখক এলেক্স নর্থ এর স্বকীয় লেখনিকে সুন্দর ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন,
“অতীতের ছায়া কখনোই পুরোপুরি মুছে যায় না।”,
“সত্য খুঁজে বের করার জন্য, আমাকে অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।“
কিংবা “সত্য কখনোই একা থাকে না।“
অবশেষে বলা লাগে অনুবাদক সালমান হকের কথা। ওর অনুবাদ সাধারনত যথেষ্ট ভাল এবং উপভোগ্য হয়ে থাকে। “দ্য হুইস্পার ম্যান”ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনুবাদ যথেষ্ট প্রাঞ্জল। পড়তে ভালো লাগবে। তবে আমি সালমানের কাছে আরো ভালো আশা করি। নিজের লেখনি দিয়ে ও নিজেই আমাকে আশাবাদি করে রেখেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক ভালো অনুবাদ আর মৌলিক লেখা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চিরকুট প্রকাশনীকেও ধন্যবাদ এত চমৎকার একটি বই উপহার দেয়ার জন্য।
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.